নতুন কুড়িঁ নিউজ” শহীদ দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস—দু-ই অভিন্ন দিন। ইংরেজি পঞ্জিকার হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি। পঞ্জিকার হিসেবে এক হলেও, তারা আসলে এক নয়।
শহীদ দিবস আমাদের জন্মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সাতচল্লিশ সালের অগাস্ট মাসে যে- শিশুর জন্ম হয়েছিল, তার জন্মদাতা রাজনীতিকরা তখন আশা করেছিলেন যে, সে বড় হয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের মস্ত প্রবক্তা হবে। অর্থাৎ হিন্দুর দেশ হিন্দুর; মুসলমানের দেশ মুসলমানের—এই হবে তার আদর্শ। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে ইসলামী জাতীয়তাবাদ। তার ভাষা হবে মুসলমানি বাংলা।
রবীন্দ্রনাথ অথবা নজরুল ইসলাম যে-বাংলা লিখেছেন, সেই পথ থেকে সে সরে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানে নতুন এক সংস্কৃতির লালন হবে।
বড় হয়ে সে কোন পথে যাবে, সেটা সাতচল্লিশের অগাস্ট মাসে বোঝা যায়নি, তবে এটাই ছিল প্রত্যাশা। সাতচল্লিশ সালে জন্ম নেবার সময়ে তার যে-নাম দেওয়া হয়েছিল, সে যা হবে বলে আগের প্রজন্মের লোকেরা আশা করেছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্পকালের মধ্যেই তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছিল। তাই ঢাকায় তমুদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল দেশ গঠিত হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই।
পরের বছর জিন্নাহ সাহেব ঢাকা সফরে আসেন মার্চ মাসে। সেখানে রেসকোর্সের ময়দানে এবং কার্জন হলে জিন্নাহ সাহেবের ভাষণ দেবার সময়ে ছাত্ররা জিন্নাহ সাহেবের প্রতিবাদ করেছিল।
তিনি বলেছিলেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। ছাত্ররা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করেছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ছাত্রদের প্রতিবাদ মেনে না নিলেও, আন্দোলন চলতে থাকলো।
তারপর বায়ান্নের একুশে (এবং বাইশে) ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। অবাধ্য ছাত্ররা আর ইসলামী জাতীয়তাবাদের দিকে ফিরে আসেনি। যে-বাঁধটা বাঙালিয়ানার জোয়ারকে ঠেকিয়ে রেখেছিল আমাদের হৃদয়ের বাইরে, তাকে চিরতরে ভেঙে দিয়েছিল।
একুশে তাই আমাদের আত্মত্যাগের কারণে বিষাদের দিন হলেও, এটা আমাদের মাতৃভাষার বিজয়ের দিন। এ দিনের পর দ্বিজাতিতত্ত্বের ধোঁয়া আর আমাদের বাঙালি পরিচয়কে আর ঘোলাটে করতে পারেনি।
যদিও ফৌজি উত্থান এবং রাজনৈতিক পালা বদলের সময়ে প্রতিবারই মধ্যপ্রাচ্যের লু হাওয়া আমাদের পরিচয়ের বেড়া ধরে নাড়া দিতে চেষ্টা করেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তুলনামূলকভাবে উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা এক সস্তা পশ্চিমা পরিচয়। এর পেছনে আমাদের সংগ্রামের কোনো ইতিহাস নেই। সে অর্থে এর কোনো ঐতিহ্য নেই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমরা সংগ্রাম করে অর্জন করিনি।
আটলান্টিক পারের এক দেশে বসবাস-রত দুজন বাঙালি ১৯৯০- এর দশকের শেষ দিকে জাতিসংঘের কাছে লিখেছিলেন যে, রোজ রোজ বিশ্বের মাতৃভাষা যখন লোপ পাচ্ছে, তখন বছরের একটা দিনে মাতৃভাষার প্রতি বিশ্ববাসীর সচেতনতা এবং ভালোবাসা জাগিয়ে দিলে কেমন হয়!
তারা আরও জানান যে, আপাতত এমন কোনো একটা দিন নেই, যা বিশ্ববাসীকে তাদের নিজের নিজের মাতৃভাষাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। জাতিসংঘে তাদের এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদ (ইউনেস্কো) আরও বিচার-বিবেচনা করে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে।
তারপর তারা বিবেচনা করে বছরের কোন দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা যেতে পারে।
ঠিক হয় যে, এ দিনটি হতে পারে একুশে ফেব্রুয়ারি। কারণ এই দিন বাঙালিরা মাতৃভাষার প্রতি তাদের অগাধ ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছিল এবং আত্মত্যাগ করেছিল।
একটু গভীরভাবে তাকালেই আমরা দেখতে পাব যে, ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে বাড়তি মর্যাদা দান করেনি। বরং এ দিনটিকে গ্রহণ করেছিল একটি সহজ স্মরণীয় দিন হিসেবে।
অপর পক্ষে, শহীদ দিবস কথাটা বাঙালিরা রক্ত দিয়ে অর্জন করেছিল। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে আমরা আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছিলাম। সে নামটিকে আমরা কোনো কিছুর বিনিময়ে বদল করতে পারি না। আমাদের পূর্ব প্রজন্মের ভাইয়েরা বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার যে, অতুলনীয় নজির স্থাপন করেছেন এবং তাদের আত্মত্যাগের একটা নাম দিয়ে গেছেন, পশ্চিমা কোনো তকমা দিয়ে তা আমরা বদলাতে পারি না। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।