শেয়ারবাজারে আবারও বড় ধরনের অস্থিরতা চলছে। কিছু শেয়ারের দাম নজিরবিহীন উত্থানের পর এবার চলছে টানা দরপতন। গত ১০ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক ৪৮২ পয়েন্ট কমেছে। আর বাজারমূলধন কমেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। একক দিন হিসাবে সোমবার সূচক ১২০ পয়েন্ট কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। কোনো কোনো হাউজে ফোর্সড সেল (ঋণ সমন্বয়ে বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি) হচ্ছে। দরপতনের প্রতিবাদে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনে সোমবার বিনিয়োগকারীরা মানববন্ধন করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের এই পতন অপ্রত্যাশিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। কারণ এর আগে বাজার চাঙ্গা করতে স্বাভাবিক শক্তিতে চলতে না দিয়ে, অসাধু সিন্ডিকেটের ওপর নির্ভরশীল ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এই সিন্ডিকেট অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। এছাড়া ব্যাংকগুলোও বিভিন্নভাবে বাজারে সক্রিয় হয়। কিন্তু বাজারের এই অস্বাভাবিক উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি অপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এই অস্থিরতার আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এছাড়া বাজারের টেকসই উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি। বিএসইসি বলছে, দরপতন নয়, বাজারে এটি স্বাভাবিক মূল্য সংশোধন।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, বাজার নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। কারণ গত এক বছরে সূচক প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পয়েন্ট বেড়েছে। সেখান থেকে কিছু মূল্য সংশোধন খুব স্বাভাবিক। তিনি বলেন, সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের পরে বাজারে কোনো মূল্য সংশোধন হয়নি। এতে কিছু বিনিয়োগকারী মুনাফা করেছে। সেই মুনাফা তারা তুলে নিচ্ছে। সবকিছু মিলে মনে হচ্ছে, মূল্য সংশোধনের শেষ সীমায় (বটম লাইনে) চলে এসেছে বাজার। এখান থেকে দ্রুতই সামনে যাবে। ফলে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কের কিছু নেই।
জানা গেছে, চলতি মাসের ১০ অক্টোবর ডিএসইর মূল্যসূচক ছিল ৭ হাজার ৩৬৭ পয়েন্ট। আর সোমবার পর্যন্ত তা কমে ৬ হাজার ৮৮৫ পয়েন্টে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ১০ কার্যদিবসে সূচক কমেছে ৪৮২ পয়েন্ট। বাজারমূলধন ৫ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে ৫ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে বাজারমূলধন কমেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। লেনদেন কমে ১ হাজার ৪শ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে বাজারে। কোনো কোনো জায়গায় অন্তত দুটি সিন্ডিকেটের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশ ও কানাডার দ্বৈত নাগরিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের একজন অধ্যাপক। বিশেষ করে বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে যুগান্তরের হাতে। অথচ শেয়ারবাজার নিয়ে গণমাধ্যমে মানুষকে জ্ঞান দিচ্ছেন তিনি।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসে বাজারের অস্বাভাবিক উত্থান হয়েছিল। আলোচ্য সময়ে ডিএসইর বাজারমূলধন ৭০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। আর মূল্যসূচক ১ হাজার বেড়েছিল ১ হাজার পয়েন্টের বেশি। লেনদেনও ছিল উচ্চ। কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম ৫ গুণ বেড়েছে। বাজার যে গতিতে বাড়ছিল, তা যে কোনো বিবেচনায় অস্বাভাবিক। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই লেনদেন স্বাভাবিক ছিল না। এখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কম। কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই পরিকল্পিতভাবে বাজার চলছে। কোম্পানি ধরে ধরে এরা দাম বাড়ায়। স্টক এক্সচেঞ্জের সার্ভিল্যান্সের রিয়েল টাইম ডাটা চলে যাচ্ছে তাদের হাতে।
আমাদের অনুসন্ধানে জানা যায়, কয়েকটি গেম্বলার গ্রুপকে অলিখিতভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরিস্থিতি একটু খারাপ হলেই কমিশন থেকে বড় হাউজ এবং কয়েকজন বড় বিনিয়োগকারীকে শেয়ার কিনে বাজার সাপোর্ট দিতে বলা হয়। আর এই সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিতে মার্জিন ঋণের ১ :০.৮ করা হয়। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগকারীর ১ লাখ টাকা থাকলে তাকে আরও ৮০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হবে। ফলে এই সিন্ডিকেট অনেকটা বেপরোয়া। কোনো কোনো ব্রোকারেজ হাউজ ওই সীমাও লঙ্ঘন করে ঋণ দিয়েছে। তবে বর্তমানে সিন্ডিকেটগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চলছে।
সিন্ডিকেটের অনেকেই বর্তমানে অনেকেই উচ্চ দামে বিমা খাতের শেয়ার কিনে আটকে গেছে। অন্যতম একটি কোম্পানি প্রভাতী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এই কোম্পানির প্রায় ৬০ শতাংশ শেয়ার বড় একটি সিন্ডিকেটের কাছে। এর নেপথ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির পর্ষদে আছেন। পাশাপাশি নিজেকে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিনিধি বলেও দাবি করেন তিনি।
তবে তার বিও অ্যাকাউন্টে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের মাত্র ৬৯ হাজার শেয়ার রয়েছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪টায় হোটেল পূর্বাণীতে একটি বিমা কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। একইভাবে ১৬ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪টায় একই হোটেল দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন। বৈঠকে কোম্পানি কর্মকর্তাদের বিকল্প একটি প্রস্তাব দেন। প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার বড় একটি গ্রুপ অব কোম্পানির কাছে বিক্রি করবে তারা। এরপর ওই গ্রুপকে পর্ষদে নিতে হবে। না হলে বার্ষিক সাধারণ পুরো কোম্পানি দখল করে নেবেন। বিষয়টি নিয়ে বাজারে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন ২০১০ সালে বাজারে বিপর্যয় হয়েছে। ওই সময়ের সঙ্গে বর্তমান বাজারের বেশ কয়েকটি জায়গার মিল রয়েছে। সে সময় বাজারে মার্জিন ঋণ ছিল সীমাহীন। ভালো কোম্পানির সংখ্যা ছিল কম। কোম্পানির মৌলভিত্তি নয়, বিনিয়োগ ছিল গুজবনির্ভর। সূচকের উত্থান ছিল খুব দ্রুত। দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল। অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে পুঁজিবাজারের উত্থানের মিল ছিল না। বর্তমানে এর সবই বাজারে রয়েছে। উলটো করোনার কারণে বর্তমানে বেশি কিছু কোম্পানির আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের এই ঊর্ধ্বগতি অত্যন্ত আশঙ্কার। এছাড়া বাজারের এই অস্বাভাবিক উত্থানকে ভালোভাবে নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, করোনার শুরুতে বাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। এরপর ফ্লোর প্রাইস (নিম্নসীমা) দিয়ে পতন ঠেকানো হয়। পরবর্তীকালে লকডাউনের কারণে ৬৬ দিন লেনদেন বন্ধ থাকে। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছর থেকে বাজারে লেনদেন এবং মূল্যসূচক বাড়তে থাকে। শুরুতে বিভিন্ন মূল্যসংবেদনশীল তথ্য ছড়িয়ে বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ায় একটি চক্র। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। পর্যায়ে ক্রমে শুরু হয়, খাতভিত্তিক দাম বৃদ্ধি। এভাবে বাজারের উত্থান হয়।
সোমবারের বাজার : একক দিন হিসাবে সোমবার ডিএসইতে ৩৭৬টি কোম্পানির ৩১ কোটি ৬৩ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যার মোট মূল্য ১ হাজার ৪৭০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে দাম বেড়েছে বেড়েছে ৪৭টি কোম্পানির শেয়ারের, কমেছে ৩০৭টি এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২২টি কোম্পানির শেয়ারের দাম।
ডিএসই ব্রড সূচক আগের দিনের চেয়ে সোমবার ১২০ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৮৮৫ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসই-৩০ মূল্যসূচক ৫৩ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৬৪৪ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসইএস শরীয়াহ সূচক ২২ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৪৬৫ পয়েন্টে নেমে এসেছে। সোমবার যে সব হাউজ বেশি শেয়ার বিক্রি করেছে এগুলো হলো ইবিএল ইনভেস্টমেন্ট, ব্র্যাক ইপিএল এবং সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল অন্যতম।
শীর্ষ দশ কোম্পানি : ডিএসইতে সোমবার যে সব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বেশি লেনদেন হয়েছে সেগুলো হলো-ডেল্টা লাইফ, বেক্সিমকো লিমিটেড, ফরচুন সুজ, ওরিয়ন ফার্মা, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, জেনেক্স ইনফোসিস, আইএফআইসি, লাফার্জহোলসিম সিমেন্ট এবং এনআরবিসি ব্যাংক।
একই দিন ডিএসইতে যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশি বেড়েছে সেগুলো হলো-শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল, ফু-ওয়াং সিরামিকস, সোনালি পেপার, ফরচুন সুজ, ন্যাশনাল ফিডস, ম্যাকসন স্পিনিং, বিবিএস কেবলস, মেট্রো স্পিনিং এবং ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। অন্যদিকে যে সব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশি কমেছে সেগুলো হলো-ওএএল, সামিট পাওয়ার, ডিএসএসএল, ইসলামিক ফাইন্যান্স, টুংহাই ইন্ডাস্ট্রিজ, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, মেঘনা পিইটি, তাল্লু স্পিনিং, এস আলম কোল্ড এবং জাহিন স্পিনিং।